রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার করা হবে– প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস 

জহির উদ্দিন মাহমুদ / ১২ পোস্ট কাউন্ট
আপডেট রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

জহির উদ্দিন মাহমুদ 

সরকারের প্রথম অধ্যায় শেষ, সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু * দ্বিতীয় পর্বেও হাঙ্গামা হবে, কিন্তু আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে * ষড়যন্ত্রকারীরা ট্রাম্পের কাছে গিয়েও সুবিধা করতে পারেনি

অন্তর্বর্তী সরকার ও কমিশন সহযোগিতা করলেও আকাঙ্ক্ষিত সংস্কার করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের সূচনা বক্তব্যে একথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, গোটা বিশ্ব বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্রকারীরা ট্রাম্পের কাছে গিয়েও সুবিধা করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো।
বেলা ৩টার কিছু পরে রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও কয়েকটি সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। তবে আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটে থাকা কোনো দল ও জাতীয় পার্টিকে এ বৈঠকে ডাকা হয়নি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পৃথিবীজুড়ে আমাদের একটা বড় রকম সমর্থন গড়ে উঠেছে। যে কারণে অপর পক্ষ সুবিধা করতে পারছে না। পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে, যেখানে যায়। বহু গল্প করছে, গল্প টেকাতে পারছে না। শেষমেষ তো ট্রাম্পকে নিয়ে গল্প, সে অপপ্রচার চালাতে গিয়ে চালাতে পারল না।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ একটা সমর্থন ও আন্তর্জাতিক একটা সমর্থন-এই দুই সমর্থনের ভেতর দিয়ে আমরা যদি এই নতুন বাংলাদেশ গড়তে না পারি তা আমাদের কর্মের দোষ ছাড়া আর কি বলব। আমরা এই সুযোগ ছাড়তে চাই না। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন, সহযোগিতা এবং শুভেচ্ছাকে মস্ত বড় সম্পদ বলে উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, আমরা প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় পর্বে আসলাম। দ্বিতীয় পর্বে যেন আমরা আনন্দের সঙ্গে, খুশি মনে সম্পন্ন করতে পারি। নতুন বাংলাদেশে যে নতুন নির্বাচন, নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠন হবে সে ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। এ ব্যাপারে আইনকানুন সবার জানা থাকবে, এটা নড়চড় করার উপায় কারও থাকবে না। আইনকানুন বানানোর পরে সেটা নড়চড় করার সুযোগ থাকবে না, সেজন্য এতবড় কমিশন করতে হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, আমাদের সেই দ্বিতীয় পর্ব শুরু। আপনারাই (রাজনৈতিক দল) এই দ্বিতীয় পর্বের শেষটা। আপনাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য আমরা নিয়োজিত থাকব। এই সংস্কার কমিশনের যারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয় ভবিষ্যতের প্রজন্মরা যাতে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, প্রচণ্ড সুযোগ। সুযোগ এজন্যই যে আমরা এমন পর্যায়ে আছি এখন। আমাদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে আমরা সেগুলো কাজে লাগাতে পারি। এবার কাজে লাগালে সেটা বংশ, প্রজন্ম পরম্পরায় সেটি চলতে থাকবে। একটা সুন্দর দেশ আমরা পাব। এই ভাবনা থেকেই আমরা এগুলো গ্রহণ করব।

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের সহযোগিতা চাই এটা আমি বলব না, কারণ এটা আপনাদের কাজ। আমার কাজ না, একার কাজ না। যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, আপনাদের বলতে সমাজের কল্যাণে কোন কোন জিনিস করতে হবে, কিভাবে করতে হবে। যেটা এক্ষুণি করা যাবে বলবেন, এটা এক্ষুণি করা দরকার, সামান্য রদবদল থাকলে বলবেন সামান্য রদবদল করে দেন, সেটা আপনাদের ইচ্ছা। আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম। আমাদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক করার, দূরত্ব সৃষ্টি করার মতো প্রবণতা আছে। কিন্তু এই একটি জায়গায় এক ছিলাম, এখনো এক আছি। আগামীতেও আমরা এক থাকব। সে বিশ্বাস আমার আছে। প্রথম অধ্যায়ে যেসব শক্তি আমাদের ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে, ভণ্ডুল করার চেষ্টা করেছে, তাদেরও সুন্দরভাবে সবাই মিলে মোকাবিলা করতে পেরেছি।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় পর্বেও হাঙ্গামা হবে। কারণ যাদের বাংলাদেশের মানুষ তাড়িয়ে দিয়েছে, অস্বীকার করেছে, ত্যাগ করেছে তারা ফিরে আসার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। প্রতিটি দিন তাদের জন্য মূল্যবান, দেরি হলে তাদের জন্য অসুবিধা। সেই জন্য আমাদের সবাইকে শক্ত থাকতে হবে, মজবুত থাকতে হবে, আমরা যেগুলো আলাপ করছি সেগুলোতে মতভেদ থাকবে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় আমরা একত্র নই। আমরা একত্র থাকব।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই যে আইনকানুন, নীতিমালা বানিয়ে দেব। একবার বানিয়ে দিলে তারপর থেকে চলতে থাকবে। একটা ট্রান্সপারেন্ট খেলা হবে। খেলায় জিতলে কেউ সন্দেহ করবে না যে কেউ জিতিয়ে দিয়েছে। এত ট্রান্সপারেন্ট কেউ সন্দেহ করবে না।

তিনি বলেন, এখন যে খেলা চলছে, ঠিকমতো জিতলেও সন্দেহ করে। বলে কিছু একটা কলকাঠি নেড়ে করেছে। এই কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি আমাদের মনের ভেতর গেঁথে গেছে। কলকাঠি ছাড়া যে দেশ একটা নিয়মে চলতে পারে সেটা আমরা ভুলে গেছি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা বলেন, আর দেশীয় সমর্থনের কথা বলেন, এটা বলতে গেলে মনটা বড় হয়ে যায়। জাতিসংঘের সমর্থন-জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিবেদনে সারা পৃথিবী বদলে গিয়েছে। আর কত সমর্থন চাই আমরা। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে বলে দিয়েছে কোথায় কিভাবে মেরেছে, এর থেকে বের হওয়ার তো কারও উপায় নেই।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল, এই এক প্রতিবেদনে সব সমাপ্ত। বলতে পারবে কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হবে না। আরও অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাদের প্রতিবেদনে অত্যন্ত জোরালোভাবে তাদের অপরাধের কথা উঠে এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা সেদিন আয়নাঘরে গেলাম, মানুষ কত নির্মম হতে পারে, বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে, নৃশংস হতে পারে এর চেয়ে বড় নমুনা বোধ হয় পাওয়া যাবে না। আমাদের শুধু দেখতে কষ্ট লেগেছে, যারা বছরের পর বছর সেখানে থেকেছে। তাদের কথা চিন্তা করুন। তাদের প্রতিটি বর্ণনা, তাদের অভিজ্ঞতা গুম তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
জুলাই চার্টারের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচন-প্রেস সচিব : বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমির সামনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই চার্টারের ওপর নির্ভর করবে আমাদের নির্বাচনটা কবে হবে। কারণ এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন-ডিসেম্বরে মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা হয়তো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারব। আর পরে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে তারা বাস্তবায়ন করবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ৬ মাসের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে, আমাদের আশা থাকবে সব রাজনৈতিক দল এটাতে স্বাক্ষর করবে। সেটা হবে জুলাই চার্টার।
সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, ‘আর যেসব ক্ষেত্রে প্রধান ঐকমত্য প্রয়োজন সেটার জন্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকে পুনর্গঠন এবং তারপরে আমরা যে রাজনৈতিক সমাধানে যাচ্ছি, কীভাবে আমাদের ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনটা হবে তার জন্য আজকে রাজনৈতিক সংলাপের সূচনা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের সূচনা।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর বিভাগ